১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কময় একটি দিন। ঘাতকরা এই দিন জাতির পিতা ও পাঁচ পরিবারের সদস্যদের নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করে। শিশু রাসেলকেও বাঁচতে দেয়নি ঘাতকের বুলেট। বর্বর হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠা খুনিরা ছিল সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য। পর্দার অন্তরালে ছিল সামরিক ও বেসামরিক ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৫ই আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের তারাই ছিল সুবিধাভোগী। দেশি-বিদেশি অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী বঙ্গবন্ধুকে সাবধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপতির এমন অরক্ষিত বাড়িতে বসবাস মোটেই নিরাপদ নয় । ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কখনো শঙ্কিত ছিলেন না। অবিচল আস্থায় বলতেন, 'আমাকে কোনো বাঙালি মারবে না ।
১৫ই আগস্ট, সেদিন ভোরের আলো তখনও ভালোভাবে ফুটে ওঠেনি। আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে ঢাকা । জাতির পিতা সপরিবারে ঘুমিয়ে আছেন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে। ঘাতকের দল ট্যাংক, কামান, মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। টার্গেট বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার এবং আত্মীয়-পরিজনকে হত্যা করা। আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আক্রমণ শুরু হয় । মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর পাশা, মেজর নূরের নেতৃত্বে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। জোর করে খুনির দল বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। তখন ভোরের আলো অনেকটা পরিষ্কার। গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত ধানমণ্ডির অধিবাসীরা। নীলনকশা অনুযায়ী খুনিচক্র ঝাঁপিয়ে পড়ল জাতির পিতার পরিবারের ওপর।
চিৎকার, হট্টগোল আর গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে বঙ্গবন্ধু পরিবারের। তারা একে একে হত্যা করে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে। শিশু রাসেলও রেহাই পায়নি। একজন ঘাতক শেখ রাসেলকে উপরতলা থেকে নিচে নিয়ে আসে। ভয়ে কাতর, বিহবল হয়ে পড়ে ১০ বছরের শিশু রাসেল। মায়ের কাছে যাবার জন্য সে কাঁদতে শুরু করে। নিষ্ঠুর ঘাতক রাসেলকে উপরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে । স্টেনগান থেকে বঙ্গবন্ধুর বুক লক্ষ্য করে গুলি করে ঘাতকের দল। তাঁর বুকে ১৮টি গুলির আঘাত পাওয়া যায়। হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেলকে। পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি আমাল, সহোদর শেখ নাসের, কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বেবি সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান ।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ভিত্তি নির্মাণে কৃতিত্বের পরিচয় দেন । তারপরও বাংলাদেশের রূপকার, এদেশের সব মানুষের অতিপ্রিয় নেতাকে এভাবে জীবন দিতে হলো । এমন করুণ, নির্মম, হৃদয়বিদারক হত্যার নজির বিশ্ব ইতিহাসে নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রে দেশি-বিদেশি চক্র এবং সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত ছিল । খুনি চক্রের নেতৃত্বে ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ । বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের কারণে বিশ্বের চোখে আমরা কৃতঘ্ন জাতিতে পরিণত হয়েছি । ক্ষমতা দখলকারীরা বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কীর্তি মুছে ফেলার চেষ্টা করে । তাদের চেষ্টা সফল হয়নি । কারণ বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয় । কবি অন্নদাশঙ্কর রায় কয়েকটি পঙ্ক্তির মধ্য দিয়ে সে কথাই বলেছেন-
‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান ।'